Hadisur Rahman
ঢাকাWednesday , 6 October 2021
  1. Education News
  2. Featured
  3. Health & Fitness
  4. Job Circular
  5. Technology
  6. Video
  7. কুইজ
  8. গল্প
  9. সুরা

আধুনিক আরবি সাহিত্যে নাজিব মাহফুজের অবদান Naguib Mahfouz

Hadisur Rahman
October 6, 2021 7:19 pm
Link Copied!

নাজিব মাহফুজ

নাগিব মাহফুজ বিংশ শতকের ইজিপ্টের তথা আরবি ভাষার সম্ভবতঃ সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক। ১৯৮৮ সালে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের বিশ্বব্যাপী প্রভাবের স্বীকৃতি পান নোবেল পুরস্কার লাভে। আরবি ভাষার লেখকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম (এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপক। আধুনিক আরবি সাহিত্যের যে লেখকেরা প্রথম সাহিত্যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রয়োগ শুরু করেন, তাঁদের মধ্যে মাহফুজ ও তহা হুসেইন (১৮৮৯-১৯৭৩) অন্যতম। আজ আরব দুনিয়া অতিক্রম করে মানবতাবাদী নাজিব মাহফুজ স্থান করে নিয়েছেন বিংশ শতকের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসকারদের সারিতে।

 
 

নাগিব মাহফুজ

মাহফুজ – জীবন ও সাহিত্য:
 
বিশ্বখ্যাত আধুনিক আরবি সাহিত্যিক মাহফুজের জন্ম প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইজিপ্টে। ১১ ডিসেম্বর ১৯১১ সালে রাজধানী কায়রো শহরের পুরনো এলাকা আল-গামালিয়ায় একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৪ সালে, যখন তাঁর বয়স ১৩ বছর, পিতা আবদেল আজিজ ইব্রাহিম সপরিবারে আল-গামালিয়া থেকে স্থানান্তরিত হয়ে পুরোনা কায়রো শহরের উত্তরে নতুন শহরতলী এলাকা আল-আব্বাসিয়ায় চলে যান। তাঁরা বেশ কয়েক বছর সেখানে বসবাস করেন। পিতার মৃত্যুর পরও নাগিব মাহফুজ তাঁর মা ফাতিমাকে নিয়ে সেখানে অনেকদিন বসবাস করেন। তারপর তিনি চলে আসেন কায়রোর পুরনো শহরের আল-আজহার এলাকায়।
 
মাহফুজ ছাত্রজীবন থেকেই দর্শনের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে (অর্থাৎ তৎকালীন রাজা ফুয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ে) দর্শনশাস্ত্র নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ১৯৩৪ সালে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। এরপর তিনি ইসলামী অতীন্দ্রিয়বাদ নিয়ে গবেষণা করার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু এই গবেষণা তিনি সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হন নি। দর্শন নিয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি ছিলেন সাহিত্যের এক গভীর পাঠক। ছাত্রজীবনে তিনি ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় রচিত বহু গ্রন্থ পড়েছেন বলে জানিয়েছেন। মাহফুজ ১৭ বছর বয়সে সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ১৯৩২ সালে তিনি জেমস বাইকির (১৮৬৬-১৯৩১) লেখা ‘এনশ্যেন্ট ইজিপ্ট’ গ্রন্থের ‘মিসর আল-কাদিমা’ নামে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীনই তিনি তিনটি ছোট আকারের ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে ফেলেন। তবে সাহিত্য সৃষ্টির শুরুতেই খ্যাতির সুযোগ তাঁর হয় নি, করতে হয়েছে কঠিন সাধনা। তাঁর লিখিত প্রথম উপন্যাস ‘আবাস-আল-আকদার’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে, সালামা মুসা (১৮৮৭-১৯৫৮) সম্পাদিত ‘আল-মাজাল্লা আল-জদিদা’ (‘নতুন প্রেক্ষা’) পত্রিকায়।
 
১৯৯২ সালে ইংরাজী সাহিত্য পত্রিকা ‘দ্য প্যারিস রিভিউ’তে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর সাহিত্য কর্মের শুরুর কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
 
“১৯২৯ সালে আমার লেখার যাত্রা শুরু। তখন আমার সমস্ত কাহিনী প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। মাজাল্লার সম্পাদক সালামা মুসা আমায় বলতেন, ‘তোমার সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু এখনও ঠিক সেই জায়গাটায় পৌঁছাও নি।’
 
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস আমার বিশেষভাবে মনে আছে, কারণ সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু, হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলেন। আমার কাহিনী ‘আবাস-আল-আকদার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল, আমার জন্য মাজাল্লা প্রকাশকদের পক্ষ থেকে এক অপ্রত্যাশিত উপহার। এ আমার জীবনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।”
 
২৩ জুলাই, ১৯৫২ সালে সংগঠিত ইজিপ্টের বিপ্লবের আগেই তাঁর প্রায় ১০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই বিপ্লবের বৌদ্ধিক সংগঠনে তাঁর রচনা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই বিপ্লবের পর, তিনি পাঁচ বছর তাঁর সাহিত্যকর্ম বন্ধ রাখেন। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সর্বজনপরিচিত উপন্যাস ‘কায়রো ত্রয়ী’ – সারা বিশ্বে তাঁর স্বীকৃতির মুখ্য উৎস। তাঁর লেখা মোট উপন্যাসের সংখ্যা ৩৫টি এবং ছোটগল্পের সংখ্যা প্রায় ৩৫০টি, ১৫টি ছোটগল্পের সঙ্কলনে প্রকাশিত। এছাড়াও তিনি লিখেছেন ৫টি নাটক এবং প্রায় ২৫টি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। পৃথিবীর অনেক ভাষায় তাঁর রচনা অনুদিত হয়েছে। তাঁর লিখিত গল্প নিয়ে ইজিপ্টে ও অন্যান্য দেশে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র।
 
নাগিব মাহফুজ তাঁর সাহিত্য সাধনার প্রথম দশকে বেশ কিছু সংখ্যক ছোটগল্প রচনা করেছেন, এবং তার অধিকাংশই নাগরিক জীবনের নানা অন্ধকার দিক নিয়ে লিখিত। মাহফুজের কাহিনীর অনেক চরিত্রই সরাসরি জীবন থেকে নেওয়া। ফলে, অতি দ্রুত সময়ে তিনি পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তাঁর প্রথম তিনটি উপন্যাস ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে রচিত – ‘আবাস-আল-আকদার’ (‘ভাগ্যের পরিহাস’, ইংরাজী অনুবাদে ‘খুফুর প্রজ্ঞা’)(১৯৩৯), ‘রাদুবিস’ (১৯৪৩) (ইংরাজী অনুবাদে ‘নুবিয়ার রদোপিস’) ও ‘কিফা তিবা’ (১৯৪৪) (‘থিবির সংগ্রাম’)।
 
১৯৪৫ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে মাহফুজের যে উপন্যাসগুলি প্রকাশিত হয়, তার বিষয়বস্তু সাধারণভাবে বাস্তবতাবাদী। এই উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘খান-আল-খলিলি'(১৯৪৫), ‘আল-কাহিরা আল-জদিদা’ (১৯৪৬) (‘নতুন কায়রো’), ‘জুকাক-আল-মিদাক’ (‘মিদাক গলি’) (১৯৪৭), ‘আল-সরাব’ (১৯৪৮)(‘মরীচিকা’), ‘বিদায়া ওয়া নিহায়া’ (১৯৪৯)(‘শুরু এবং শেষ’) ও ‘সুলাসিয়া-আল-কাহিরা’ (১৯৫৭) (‘কায়রো ত্রয়ী’) বা ‘আল-সুলাসিয়া’ (‘ত্রয়ী’) বিশেষভাবে খ্যাত।
 
‘আওলাদ হারতিনা’ (১৯৫৯)(‘আমাদের পাড়ার শিশুরা’ ইংরাজী অনুবাদে, ‘গেবেলায়ুইর শিশুরা’) তাঁর রচনারীতিতে পরিবর্তনের সুচক। রূপক ও প্রতীকধর্মী রাজনৈতিক বিষয়সমূহ এই সময়ে তিনি তাঁর লেখায় তুলে ধরেন। তাঁর লেখায় দার্শনিক ও জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিষয়সমূহ প্রাধান্য পেতে শুরু করে। ‘গেবেলাইর শিশুরা’ গ্রন্থটি একই সঙ্গে বিখ্যাত এবং বিতর্কিত। এই উপন্যাস ১৯৫৯ সালে দৈনিক ‘আল আহরাম’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলেও ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের বিরোধের কারণে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ইজিপ্টে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৬৭ সালে এই উপন্যাসটি লেবাননের বেইরুট থেকে সর্বপ্রথম পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ সালে এই উপন্যাসের আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ফিলিপ স্টুয়ার্ট। তাঁর সাহিত্য রচনার দ্বিতীয় কালপর্বে প্রকাশিত অন্যান্য উল্লেখনীয় উপন্যাস – ‘আল-লিস ওয়া আল-কিলাব’ (১৯৬১) (‘চোর ও কুকুর’), আল-সুমান ওয়া আল-খরিফ’ (১৯৬২) (‘কোকিল ও শরৎকাল’), ‘আল-তরিক’ (১৯৬৪)(‘উপায়’, ইংরাজী অনুবাদে ‘সন্ধান’), ‘আল-শহাদ’ (১৯৬৫) (ভিখারী), ‘সরসরা-ফৌক-আল-নীল’ (১৯৬৬) (‘নীল নদের উপর চুটকিগল্প’), ‘মিরামার’ (১৯৬৭), আল-মরায়া’ (১৯৭২) (‘আয়না’), ‘আল-হুব তহত আল-মটর’ (১৯৭৩) (‘বৃষ্টিতে ভালবাসা’), ‘আল-কারনাক’ (১৯৭৪) (ইংরাজী অনুবাদে ‘কারনাক কাফে’), ‘মলহামত-আল-হারাফিশ’ (১৯৭৭) (‘হারাফিশের মহাকাব্য’), ‘আফরা-আল-কুব্বা’ (১৯৮১)(‘গম্বুজের আনন্দ’, ইংরাজী অনুবাদে ‘বিবাহসঙ্গীত’), ‘লায়ালি-আলফ-লায়লা’ (‘এক সহস্র রাত্রি’, ইংরাজী অনুবাদে, ‘আরব্য রজনী ও দিবস’) (১৯৮২) ‘ইওয়াম কতল আল-জায়েম’ (১৯৮৫) (‘যেদিন নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল’), ‘আল-আ’ইশ ফি আল হকিকা’ (১৯৮৫) (‘সত্যে জীবনযাপন’, ইংরাজী অনুবাদে ‘আখেনাতেন, সত্যে অধিষ্ঠিত’) এবং ‘হাদীস আল-সাবা ওয়া আল-মাসা’ (১৯৮৭) (সকাল ও সন্ধ্যার কথাবার্তা’)। ১৯৯৪ সালে তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘আশদা আল-সীরা আল-ধাতিয়া’ (‘একটি আত্মজীবনীর প্রতিধ্বনি’) প্রকাশিত হয়।
 
৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত নাগিব মাহফুজ বিবাহ করেন নি। তাঁর আশঙ্কা ছিল, যদি বিয়ে করে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে সাহিত্য রচনার ক্ষতি হবে। কিন্তু সেই আশঙ্কাকে সরিয়ে রেখে, ১৯৫৪ সালে নাগিব মাহফুজ বিবাহ করেন আলেকজান্দ্রিয়ার এক নারী, আতিয়াতাল্লা ইব্রাহিমকে। তাঁদের দুই কন্যা – উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা। তবে তিনি তাঁর নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সব সময়ই খুব অন্তর্মুখী ছিলেন ও একা থাকতে ভালোবাসতেন। ‘দ্য প্যারিস রিভিউ’তে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছেন-
 
“আমি কখনো নৈশভোজ বা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে চাই না। এমনকি আমার বন্ধুদের বাড়িতেও ঘুরতে যাই না। আমি তাদের সঙ্গে দেখা করি ক্যাসিনো ‘কসর-আল-নীল’ অথবা কোনো কফি হাউসে।”
 
১৯৩৪ সালে স্নাতক হবার পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নাগিব মাহফুজ ইজিপ্ট সরকারের বিভিন্ন পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৩৪ সালে তিনি তৎকালীন রাজা ফুয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিভাগে করণিক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ধর্মীয় অনুদান (ওয়াকফ) মন্ত্রণালয়ে সংসদীয় সচিব নিযুক্ত হন। ১৯৪৫ সালে তিনি আল-গামালিয়া এলাকার আল-ঘুরী গ্রন্থাগারে স্থানান্তরিত হন। এরপর, তিনি প্রথমে সংস্কৃতি দপ্তরের চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ বিভাগে কাজ করেন ও পরে ইজিপ্ট সরকারের চলচ্চিত্র সহায়তা সংস্থার মহানির্দেশক নিযুক্ত ছিলেন। সর্বশেষ অবসরগ্রহণের পূর্বে তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। অবসরগ্রহণের পর তিনি ইজিপ্টের কয়েকটি প্রভাবশালী পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত সাম্প্রতিক বিষয়ের উপর স্তম্ভ লিখেছেন, তবে মুখ্যতঃ লিখেছেন দৈনিক পত্রিকা ‘আল আহরাম’-এ। তাঁর লেখা এই স্তম্ভগুলি নিয়ে ২০০১ সালে ‘সিদী-গাবের স্টেশনে নাগিব মাহফুজ’ নামে একটি পুস্তক প্রকাশিত হয়। ১৪ অক্টোবর ১৯৯৪ সালে তিনি মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণে গুরুতর আহত হন। প্রায় ৭০ বছর সক্রিয় সাহিত্য রচনার সঙ্গে যুক্ত এই মহান সাহিত্যিকের ৩০ আগস্ট, ২০০৬ সালে কায়রোয় জীবনাবসান হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। তাঁর দীর্ঘ সাহিত্যজীবন আধুনিক আরবি সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
 
মাহফুজের উপন্যাস – সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
 
ইজিপ্টের সাহিত্যিক মুহাম্মদ হুসাইন হায়কালের (১৮৮৮-১৯৫৬) ১৯১৩ সালে লেখা ‘জয়নব’ সম্ভবতঃ আরবি ভাষায় লেখা প্রথম প্রকৃত উপন্যাস। কিন্তু, নাগিব মাহফুজের আগে আরবি ভাষার কোনো সাহিত্যিকের উপন্যাস এত বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে নি। প্রাবন্ধিক কবির চৌধুরী, তাঁর ‘বিশ্ব সাহিত্যে নয় রত্ন’ গ্রন্থে নাগিব মাহফুজের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে লিখেছেন:
 
“নাগিব মাহফুজের আগে আরবি ভাষায় কোনো লেখক উপন্যাস রচনা করে এত জনপ্রিয়তা পাননি। আরবি ভাষায় তার আগে যে ন্যারেটিভ ফর্ম দেখা যায়, তা আধুনিক উপন্যাসের ফর্মের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এডওয়ার্ড সাঈদের বিশ্লেষণে ওই ফর্মগুলো হলো কিসরা, সুরা, হাদিস, খুরাফা, খবর, নাদিরা ও মাক্কামা। এর একটিও আধুনিক উপন্যাসের ফর্ম নয়। নাহিব মাহফুজ পাশ্চাত্যের উপন্যাসের আঙ্গিক থেকে ধার করেই তার উপন্যাস-শিল্প নির্মাণ করেছেন। নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ীই তিনি ফ্লবেয়ার, বালজাক, জোলা, কাম্যু, টলস্টয় এবং দস্তয়েভস্কির কাছে সবিশেষ ঋণী। তিনি এদের সবার লেখা পড়েছেন ফরাসি ভাষায়। এরা ছাড়া আর যে একজন পাশ্চাত্যের লেখক তার উপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছেন তিনি হলেন মার্সেল প্রুস্ত। নাগিব মাহফুজ প্রুস্তের কালজয়ী সাহিত্যকর্ম ‘অতীতের বিষয়াবলীর স্মৃতি’ দ্বারা প্রবলভাবে আলোড়িত হন। ওই উপন্যাসের কালের ধারণা নাগিবের একাধিক রচনাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছেন।…নাগিব মাহফুজের প্রায় সব উপন্যাসে কাল একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার চরিত্ররা সবসময়ে কাল নিয়ে ভাবে। তার উপন্যাসে আমরা প্রায়শ নিম্নোক্ত বাক্যাবলীর সাক্ষাৎ পাই: “সময় এক ভয়ঙ্কর সহযাত্রী”, ‘সময় আমার বন্ধুর অবস্থা এ কী করেছে? তার মুখে একটি বীভৎস মুখোশ এঁটে দিয়েছে!”
 
মাহফুজের সাহিত্য জীবনের প্রথম তিনটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্যে ‘আবাস-আল-আকদার’-এর কাহিনীর কাল প্রাচীন ইজিপ্টের চতুর্থ রাজবংশের ফারাও খুফুর রাজত্বকাল। এই উপন্যাসটি তিনি প্রথমে নাম দিয়েছিলেন ‘হিকমত খুফু’ (‘খুফুর প্রজ্ঞা’), কিন্তু, পরে বর্তমান নামে প্রকাশিত হয়। ‘রাদুবিস’-এর কাহিনীর কাল প্রাচীন ইজিপ্টের ষষ্ঠ রাজবংশের ফারাও দ্বিতীয় মেরেনরে-এর সংক্ষিপ্ত রাজত্বকাল। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নুবিয়ার এক লাস্যময়ী সুন্দরী ‘রাদুবিস’। ‘কিফা তিবা’র পটভূমি সাধারণপূর্ব ষোড়শ শতকে এশিয়ার হিকসোসদের অধীনতা থেকে মুক্তির জন্য ইজিপ্টের অধিবাসীদের সংগ্রাম এবং শেষ পর্যন্ত অষ্টাদশ রাজবংশের প্রথম ফারাও আহমোসের জয়।
 
‘খান-আল-খলিলি’ কায়রোর আল-আজহার মসজিদের পাশে একটি বাজার, এই বাজারের অজস্র অলিগলি ও তাদের উপাখ্যানকে কেন্দ্র করেই নাগিব মাহফুজ লিখেছেন তাঁর ‘খান-আল-খলিলি’ উপন্যাসটি। কাহিনীর পটভূমি সেপ্টেম্বর, ১৯৪১ থেকে আগস্ট, ১৯৪২ সাল পর্যন্ত জার্মান বিমানবাহিনীর ক্রমাগত হানার সময়কার কায়রো। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দুই ভাই – আহমদ আকিফ ও রাশিদ আকিফ। মাহফুজের প্রথমদিকের দুটি উপন্যাস ‘খান-আল-খলিলি’ ও ‘আল-কাহিরা আল-জদিদা’য় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি তাঁর সহানুভূতি এবং ‘ইসলামী ভ্রাতৃত্ব’ সংগঠনের মৌলবাদী চিন্তার প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণার প্রকাশ দেখা যায়।
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কায়রো শহরকে কীভাবে বদলে দিয়েছিল, সেই কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে ‘জুকাক-আল-মিদাক’। মাহফুজের প্রথম দিকের উপন্যাসের মধ্যে ‘জুকাক-আল-মিদাক’ সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত, সম্ভবত ঐ সময় পর্যন্ত তাঁর সবচেয়ে পরিণত সৃষ্টিও। এই উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে ১৯৯৫ সালে মেক্সিকোতে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে- ‘মিদাক গলি’ নামে।
 
ইজিপ্ট, আরব দুনিয়া ও বিশ্বপরিসরে মাহফুজের ব্যাপক জনপ্রিয়তার উৎস তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘সুলাসিয়া-আল-কাহিরা’ (‘কায়রো ত্রয়ী’)। এই সুবিশাল উপন্যাস আবদ আল-জওয়াদ পরিবারের তিনটি প্রজন্মের কাহিনী নিয়ে ১৯১৯ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ব্যাপ্ত তিনটি ধারাবাহিক উপন্যাসের সমাহার – ‘বায়ান-আল-কাসরায়েন’ (‘দুই প্রাসাদের মাঝে’, ইংরাজী অনুবাদে ‘প্রাসাদ পথ’) (১৯৫৬), ‘কসর আল-শউক’ (‘বাসনার প্রাসাদ’) (১৯৫৭) ও ‘আল-সুক্কারিয়াহ্’ (‘শর্করা পথ’)(১৯৫৭)। এই তিনটি উপন্যাসের নামকরণ করা জয়েছে নাগিব মাহফুজের পুরনো এলাকা আল-গামালিয়ার তিনটি রাস্তার নামে। ‘বায়ান-আল-কাসরায়েন’ কাহিনীর প্রধান চরিত্র, এক কঠোর রক্ষণশীল কায়রোবাসী আহমদ আবদ আল-জওয়াদের বাড়ির রাস্তার নাম। আহমদ আবদ আল-জওয়াদের তিন ছেলে – ইয়াসিন, ফাহমি আর কামাল; আর দুই মেয়ে – আয়েশা আর খাদিজা। ‘কসর আল-শউক’ আহমদের বড় ছেলে ইয়াসিনের বাড়ির রাস্তার নাম আর ‘আল-সুক্কারিয়াহ্’ আহমদের কন্যা খাদিজার বাড়ির রাস্তার নাম। কেউ কেউ এই উপন্যাসকে তলস্তয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’র সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। ‘কায়রো ত্রয়ী’ উপন্যাসে মাহফুজের রাজনৈতিক বিশ্বাস, বিশেষ করে ওয়াফদ দলের প্রতি তাঁর আকর্ষণ প্রতিফলিত হয়েছে। ‘কায়রো ত্রয়ী’র জন্য নাগিব মাহফুজ ১৯৫৭ সালে ইজিপ্টের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
 
‘আফরা-আল-কুব্বা’ উপন্যাসের মুখ্য চার চরিত্র একটি নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। এই উপন্যাসে দেখা যায় কাল কীভাবে এবং কতভাবে ভয়ঙ্কর রূপান্তর সাধন করে। প্রেম রূপান্তরিত হয় ঘৃণায়, সুন্দর হয়ে ওঠে কুৎসিত, বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের জায়গায় আসে লাম্পট্য। এর চিহ্ন আমরা দেখি উপন্যাসের চারটি চরিত্র – তারিক রামাদান, করম ইউনিস, হালিমা, আব্বাস ইউনিস, এমনকি যে বাড়িতে আব্বাস বড় হয়ে উঠেছে, তার মধ্যেও। ‘আফরা-আল-কিব্বা’ মাহফুজের সব উপন্যাসের মতোই কালের এক দর্পণ এবং ঐ সময়ের চরিত্রাবলীর উপর তার যে প্রভাব পড়েছে, সে ইতিহাস। এই কাজটি করার জন্য মাহফুজ গতানুগতিক বর্ণনার দ্বারস্থ হন নি। উপন্যাসের চরিত্রদের শারীরিক বর্ণনা দানের চাইতে তিনি অধিকতর মনোযোগ দিয়েছেন তাদের অন্তরের হতাশা, ক্ষোভ ও যন্ত্রণা ফুটিয়ে তোলার প্রতি। আর সেই উদ্দেশ্যে তিনি ব্যবহার করেন চেতনার অন্তঃশীলা প্রবাহের রীতি এবং অন্তর্ভাষণ। এই উপন্যাসের প্রত্যেক প্রধান চরিত্র তাদের নিজের মত করে নিজের কথা বলে, ঘটনার নিজস্ব ব্যাখ্যা দেয় এবং এই ভাবে জীবনের বাস্তব রসদ থেকে নিজস্ব নাটক নির্মাণ করে।
 
নাগিব মাহফুজের ১৯৮২ সালে লেখা ‘লায়ালি-আলফ-লায়লা’ প্রাচীন আরবের ‘আরব্য রজনী’র কাহিনী বলার রীতি ও রূপক ব্যবহার করে বর্তমান ইজিপ্টের সমাজ ও রাজনীতি, বিশেষভাবে তৎকালীন ইজিপ্ট সরকারের নীতি সম্পর্কে তাঁর বিরূপ অভিমতের প্রকাশ। এই উপন্যাসে মাহফুজ প্রাচীন ‘আরব্য রজনী’র ১৩টি সম্পর্কহীন কাহিনীকে আধুনিক সূত্রের মাধ্যমে যুক্ত করেছেন।
মাহফুজের ‘আল-আ’ইশ ফি আল হকিকা’ একটি অসামান্য সৃষ্টি। আরবি ভাষায় এই উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে, কায়রোতে, লেখক স্বয়ং এই রচনা প্রকাশের সময় উপস্থিত ছিলেন। এই অনন্য উপন্যাসের কাহিনী অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। উপন্যাসের পটভূমি প্রাচীন ইজিপ্টের ফারাওদের রাজত্বকাল এবং কেন্দ্রীয় চরিত্র সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী চতুর্দশ শতকের ইজিপ্টের অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও আখেনাতেন। এই উপন্যাসে ফারাও আখেনাতেন ও তাঁর রূপসী ও ব্যক্তিত্বময়ী রাণী নেফারতিতি পাঠকদের সর্বাধিক মনোযোগ আকর্ষণ করলেও উপন্যাসকার অন্যান্য চরিত্রদের অত্যন্ত প্রাণবন্ত, বিশ্বাসযোগ্য ও আগ্রহোদ্দীপকভাবে চিত্রিত করেছেন। এই চরিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে, দেবতা আমুনের মন্দিরের মুখ্য পুরোহিত; আখেনাতেনের শিক্ষক ঋষিকল্প আয়; নিরাপত্তারক্ষীদের প্রধান হারেমহাব; ভাস্কর বেক; আখেনাতেনের বৃদ্ধ পিতা ফারাও তৃতীয় আমেনহোতেপ ও তাঁর তরুণী রাণী মিতান্নি রাজার কন্যা তাদুখিপা; আমুনের মন্দিরে মন্ত্রপাঠকারী পুরোহিত টোটো; প্রাজ্ঞ আয়-এর দ্বিতীয় পত্নী ত্যে; আয় এবং ত্যে-এর কন্যা, রাণী নেফারতিতির বৈমাত্রেয় ভগ্নী, মুতনেজমেট; আখেনাতেনের প্রতিষ্ঠিত নতুন দেবতা আতেনের মন্দিরের মুখ্য পুরোহিত মেরি-রা; সেনাপ্রধান মায়ে; পুলিশপ্রধান মাহো; আখেনাতেনের অন্যতম মন্ত্রী, সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাখত এবং ফারাও আখেনাতেনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক বেনটো। এই কাহিনীর বর্ণনাকারী সায়স শহরের এক কৌতুহলী সত্যান্বেষী তরুণ মেরিয়ামুন। এই কাহিনীর সূচনার কয়েক বছর আগে বিধর্মী বলে সর্বজননিন্দিত ফারাও আখেনাতেনের জীবনাবসান হয়েছে। বহুসংখ্যক দেবদেবীপূজক দেশে এক দৈববাণী শুনে এক ও অদ্বিতীয় দেবতা আতেন-এর উপাসনার কথা ঘোষণা করে আখেনাতেন প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেন। প্রথমে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি হয়, অপ্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কিন্তু, পরে, আখেনাতেন প্রচারিত একেশ্বরবাদ প্রত্যাখ্যাত হয়, তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন, তাঁর পুত্র তুতানখামুন ফারাও হন, বন্দী অবস্থায় আখেনাতেনের মৃত্যু হয়। তাঁকে কি হত্যা করা হয়েছিল? তাঁর বিপুল প্রাথমিক সাফল্যের রহস্য কি ছিল? মানুষ হিসাবে কেমন ছিলেন ফারাও আখেনাতেন? মেরিয়ামুন সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে ইজিপ্টের অনেক স্থানে যান – থিবি শহরের আমুনের মন্দিরে, ইজিপ্টের গ্রামাঞ্চলে এবং আখেনাতেনের নির্মিত নতুন রাজধানী, আলোকনগরী ‘আখেতাতেনে’, যে শহর এখন জনশূণ্য, পরিত্যক্ত এক অভিশপ্ত ধ্বংসপুরী। এখানে সামান্য কয়েকজন প্রহরীর নজরদারীর মধ্যে একাকী বন্দিনী জীবন কাটাচ্ছেন প্রাক্তণ রাণী নেফারতিতি।মেরিয়ামুন এই সব স্থানে গিয়ে আখেনাতেনের অনেক সমসাময়িক ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে তিনি আখেনাতেন সম্পর্কে পৃথক ভাষ্য শুনতে পান আর এইসব সাক্ষাৎকারের তথ্যের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয় এক বিচিত্র রহস্যময় চরিত্র – সত্যে অধিষ্ঠানরত আখেনাতেন। মৌলবাদী চিন্তার প্রতি মাহফুজের নিজের অন্তরের বিতৃষ্ণা এই উপন্যাসে বারবার, বিশেষভাবে, হারেমহাবের ভাষ্যের মাধ্যমে উঠে এসেছে।
 
তথ্যসূত্র:
১. Brugman, J. (1984). An Introduction to the History of Modern Arabic Literature in Egypt. Leiden: E.J. Brill. pp.293-305.
২. চৌধুরী, কবীর (২০১০). বিশ্বসাহিত্যে নয় রত্ন. ঢাকা: কথাপ্রকাশ. পৃ.৫৫-৫৯.
৩. El Enany, R. (1993). Naguib Mahfouz: The Pursuit of Meaning. New York: Routledge
৪. El Shabrawy, C. (1992). “Naguib Mahfouz, the Art of Fiction” in The Paris Review, Issue 123, Summer 1992.
৫. Moosa, M. (1997). The Origins of Modern Arabic Fiction. 2ndedition. Colorado: Lynne Rienner. pp.345-372.

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।